প্রধানমন্ত্রীর ভারত সফর নিয়ে নানা হিসেব-নিকেশ, সরকার পক্ষ উজ্জীবিত বিরোধীরা শঙ্কিত!

ঢাকা: প্রধানমন্ত্রীর শেখ হাসিনার ভারত সফর নিয়ে দেশের রাজনীতিতে চলছে নানা হিসেব-নিকাশ। একদিকে ক্ষমতাসীন দলের নেতাকর্মীরা এই সফরকে নিয়ে খুবই আশাবাদী অন্যদিকে বিরোধী দলের নেতারা এই সফরকে নিয়ে খুবই শঙ্কিত।

তাই আশা আর শঙ্কা নিয়ে বর্তমানে বাংলাদেশের রাজনীতিতে চলছে নানা গুঞ্জন। এ নিয়ে রাজনৈতিক অঙ্গনে চলছে ক্ষমতাসীন ও বিরোধী দলের বাকযুদ্ধ। সরকার পক্ষে বলা হচ্ছে এই সফরের মাধ্যমে প্রতিবেশি ভারতের সঙ্গে বন্ধুত্বের সম্পর্ক নতুন মাত্রায় উন্নীত হবে এবং দেশের জণ্য কল্যাণ বয়ে আনবে। অন্যদিকে বিরোধী জোটের নেতারা বলছেন, প্রধানমন্ত্রীর এই সফরে ভারতের সঙ্গে যেসব চুক্তির কথা শোনা যাচ্ছে তা হলে দেশের স্বাধীনতা-সার্বভৌমত্ব বিলীন হয়ে যাবে। সেই সঙ্গে দেশকে এক ভয়াবহ পরিস্থিতির দিকে ঠেলে দেয়া হবে।

কূটনৈতিক সূত্রের দাবি, দীর্ঘ সাত বছর পর দ্বিপক্ষীয় সফরে নয়াদিল্লি যাচ্ছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। ১৮ বছর ধরে ঝুলে থাকা তিস্তা চুক্তি সমাধানের বিষয়ে এখনো পর্যন্ত ইতিবাচক তথ্য দিতে পারেনি প্রতিবেশী দেশটি। তবে তিস্তা চুক্তি হোক বা না হোক প্রধানমন্ত্রীর এ সফরে দুই দেশের মধ্যকার দ্বি-পাক্ষিক সম্পর্ক আরো জোরদার হবে বলে আশা প্রকাশ করছেন কূটনীতিক বিশ্লেষকরা।

ভারতের কেন্দ্রীয় সরকার নরেন্দ্র মোদীর সঙ্গে পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী মমতা ব্যানার্জির মতানৈক্য না হওয়ায় বহু কাঙ্খিত এ চুক্তির বিষয়ে এখনো শঙ্কা কাটেনি। তারপরও এই সফরে আশাবাদী বাংলাদেশ ও প্রতিবেশী ভারত।

প্রধানমন্ত্রী ভারত সফর প্রসঙ্গে বাংলাদেশের বৃহত্তম রাজনৈতিক দল বিএনপিসহ রাজনৈতিক ও সুশীল মহলে রয়েছে নানা শঙ্কা। তারা এই সফরকে বাংলাদেশের জন্য নেতিবাচক বলে মনে করছেন। আর তাই প্রতিনিয়ত এই সফরকে নিয়ে তারা বিভিন্ন যুক্তি তর্ক উপস্থান করে যাচ্ছেন।

সম্প্রতি বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর এ প্রসঙ্গে বলেছেন, ভারতের সঙ্গে বাংলাদেশের কী চুক্তি হতে যাচ্ছে তা প্রকাশ করা ম্যান্ডেটরি।

তিনি বলেন, একটি দেশের সঙ্গে অন্য দেশের চুক্তি হতেই পারে। কিন্তু সেটা জনগণ জানবে না, সেটা হতে পারে না।

তিনি আরো বলেন, এ পর্যন্ত যতগুলো চুক্তি হয়েছে তা জনসম্মুখে প্রকাশ করা হয়নি। শুধু তাই নয়, আমরা দীর্ঘদিন ধরে অপেক্ষায় আছি আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আছে এবার বোধহয় ভারতের সঙ্গে পানি সমস্যার কিছুটা সুরাহা করবে। কিন্তু এখন পর্যন্ত এক ফোটা পানিও তিস্তা নদী পায়নি।

এ বিষয়ে দলের স্থায়ী কমিটির সদস্য গয়েশ্বর চন্দ্র রায় প্রধানমন্ত্রীকে উদ্দেশ্য করে বলেছেন, শেখ হাসিনা আপনি যোগ-বিয়োগে ভুল করছেন। যাই করেন বাংলাদেশের স্বাধীনতা সার্বভৌমত্বকে বন্ধক দিয়েন না। আপনি জনগণের ভোটে নির্বাচিত হলে যখন তখন এই জনগণকেই ব্ল্যাকমেইল করতে পারতেন না।

তিনি আরো বলেন, এবার ভারতে গেলে আঁচলটা বেঁধে যাবেন কিন্তু খুলে দিয়ে আসবেন না। বাংলাদেশের স্বাধীনতা সার্বভৌমত্ব নিয়ে খেলবেন না।

তবে এ সফর নিয়ে বেশ আশাবাদী ক্ষমতাসীন দলের নেতাকর্মীরা। তারা এ সফরকে বাংলাদেশের জন্য ইতিবাচক বলে মনে করছেন। তারা এই সফরকে দেশের জন্য খুব গুরুত্বপূর্ণভাবেও দেখছেন।

এ প্রসঙ্গে আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের বলেছেন, এভরিথিং ইজ ওপেন, নাথিং সিক্রেট।

তিনি বলেন, ভারতে যাচ্ছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। বাংলাদেশের স্বার্থেই চুক্তি হবে প্রকাশ্যে। বাংলাদেশের স্বার্থে সমঝোতা স্মারক হবে প্রকাশ্যে। নাথিং ইজ সিক্রেট, এভরিথিং উইল বি ওপেন। সবকিছু হবে খোলামেলা, নো সিক্রেসি, নো প্রাইভেসি। বাংলাদেশের স্বার্থে ভারতের সঙ্গে সমঝোতা হবে, চুক্তি হবে। সেটা বাংলাদেশের জনগণের স্বার্থে ও জাতীয় স্বার্থে হবে।

তবে দেশের রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা এ বিষয়টিকে গুরুত্বের সঙ্গে বিবেচনা করছেন।

ভারতের সঙ্গে সামরিক চুক্তির বিষয়ে মুক্তিযুদ্ধের সংগঠক ও গণস্বাস্থ্য কেন্দ্রের প্রতিষ্ঠাতা ডা. জাফরুল্লাহ চৌধুরী বলেছেন, আজ আমাদের দেশে যেসব অগণতান্ত্রিক কর্মকাণ্ড ও অপকর্ম পরিচালিত হচ্ছে সবকিছুই ভারতের মদদে হচ্ছে।

তিনি বলেন, ভারত এখন আমাদের দেশের সবকিছু নিয়ন্ত্রণ করতে নতুন করে নিরাপত্তা ও সামরিক চুক্তির জন্য সরকারের ওপর চাপ দিচ্ছে। এটা হলে দেশের স্বাধীনতা-সার্বভৌমত্ব হুমকির মুখে পড়বে, দেশকে ভয়াবহ পরিস্থিতির দিকে ঠেলে দেয়া হবে।

প্রসঙ্গত, পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের এক বিবৃতি থেকে জানা গেছে, প্রধানমন্ত্রীর ভারত সফরে অমীমাংসিত তিস্তার পানিবণ্টন চুক্তির বিষয়েও সমাধান চায় বাংলাদেশ। পাশাপাশি অন্যতম মেগা প্রকল্প গঙ্গা ব্যারাজ নির্মাণেও সহযোগিতার বিষয়ে স্পষ্ট ঘোষণা চায় ঢাকা।

ভারত এগিয়ে রেখেছে প্রতিরক্ষা সহযোগিতা সংক্রান্ত সমঝোতা (রূপরেখা চুক্তি) সইয়ের বিষয়ে। এসব বিষয় চূড়ান্ত করতে দফায় দফায় আলোচনা চালিয়ে যাচ্ছে দু’দেশ।

এদিকে সম্প্রতি তিস্তা নিয়ে বেশ কৌশলী ছিলেন ভারতের হাইকমিশনার হর্ষবর্ধন শ্রিংলা।

পররাষ্ট্র সচিব সাংবাদিকদের প্রশ্নের উত্তরে জানিয়েছেন, আমাদের দেখতে হবে কোনটি সম্ভব আর কোনটি সম্ভব নয়। সামরিক চুক্তির বিষয়টিও স্পষ্টত ‘না’।

তবে কূটনৈতিক সূত্র বলছে, প্রধানমন্ত্রীর সফরে ভারতের সঙ্গে সামরিক সহযোগিতা নিয়ে কোনো চুক্তি হচ্ছে না ঠিকই, কিন্তু সমঝোতা স্মারক সই হতে পারে, যাতে দুই দেশের সামরিক বাহিনীর মধ্যে প্রশিক্ষণ, সফর বিনিময়, যৌথ মহড়া, দুর্যোগ মোকাবেলা এবং জঙ্গি দমনে সহায়তার বিষয় থাকবে। তবে এ সমঝোতা স্মারকের মেয়াদকাল কতদিন হবে সে বিষয়ে এখনো কোনো কিছু জানা যায়নি।

জানা গেছে, এ সফরে যুদ্ধ অস্ত্র কেনার জন্য বাংলাদেশকে ৫০ কোটি ডলারের একটি ঋণ প্যাকেজ দিতে চায় ভারত। এ লক্ষ্যে দুই দেশের মধ্যকার লাইন অব ক্রেডিট (এলওসি) দেয়া সংক্রান্ত আরেকটি সমঝোতা স্মারক সই হবে। এদিকে গঙ্গা ব্যারাজ প্রকল্প নিয়েও আপত্তি তুলেছেন মমতা। তাই এ বিষয়ে পুঙ্খানুপুঙ্খভাবে সমীক্ষা চায় ভারত।

উল্লেখ্য, চার দিনের সরকারি সফরে আগামী ৭ এপ্রিল ভারতের উদ্দেশ্যে ঢাকা ত্যাগ করবেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। তার এই সফরে দু’ডজন চুক্তি, সমঝোতা স্মারক ও বিভিন্ন দলিল সই হতে পারে বলে জানা গেছে।

প্রসঙ্গত, সাত বছর পর দ্বি-পাক্ষিক সফরে ভারত যাচ্ছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। এর আগে ২০১০ সালে দ্বি-পাক্ষিক সফরে ভারত যান তিনি।

অন্যদিকে, ২০১৫ সালের জুনে প্রথম দ্বি-পাক্ষিক সফরে বাংলাদেশে আসেন ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *